তারকেশ্বর এ গঙ্গাজল নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা
তারকেশ্বর ভ্রমণ
আমার বন্ধু, কৌশিক ব্যানার্জি গত পাঁচ বছর ধরে তারকেশ্বরে গঙ্গাজল ঢালতে যায়। প্রত্যেক বছর সে আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে গঙ্গাজল ঢালতে যাবার জন্য কিন্তু আমি কোন বছরই তাকে সঙ্গ দিতে পারিনি। কারণ আমার সেভাবে কোনরকম ইচ্ছা হতো না।
প্রত্যেক বছর অনুরোধ না রাখার ফলে, নিজের মনে আমি ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করি এবং আমি ঠিক করি এই বছর আমি তাকে সঙ্গ দেব।অন্তত একবার তার ইচ্ছাটা পূরণ করি।
তাই এই বছর আমি ঠিক করি আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে যাবো এবং মনে মনে একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকি।
ঠিক একমাস আগে , সে আমাকে প্রতি বছরের মত এই বছর ও প্রস্তাব দেয় এবং আমি তাকে আশাহত না করে , বলি যদি তোর সঙ্গে কেউ না যায় তাহলে আমি যাব।
আমি তাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করিনি যে আমি তার সঙ্গে যাবই। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি তাকে আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে দিইনি এবং তার কাছ থেকে পূর্বে যাওয়ার তার যাবতীয় অভিজ্ঞতার তথ্য রোজ একটু একটু করে সংগ্রহ করছি । আমার এই অভিযান সম্পূর্ণ সফল করার জন্য নিজেও একটা সুষ্ঠু সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করলাম। কি করবো ,কি করবো না।
যাবার আগের দিন রাত্রে যখন একসঙ্গে কর্মস্থল থেকে ট্রেনে ফিরছি , স্টেশনে নামার পর বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করল অনেকটা হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় আমি তার সঙ্গ দিচ্ছি কিনা ? আমি এই বিষয় নিয়ে কোন উত্তর দিলাম না তাকে খানিকটা অন্ধকারেই রেখে দিলাম। একটা কথা চেপে রাখা কতখানি কষ্ট আমি বুঝতে পারছিলাম আমার পেটটা যেন ফুলে উঠছিল। অপ্রত্যাশিত কাউকে আনন্দ দিতে গেলে মনে হয় এরকম একটু-আধটু করতে হয়।
আমি জানতাম আমাদের এই অভিযানে মাত্র তিনজন অংশগ্রহণ করছে এক আমি, দুই আমার বন্ধু কৌশিক ব্যানার্জি তৃতীয় জন আমাদের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ জয়ন্তদা। জয়ন্তদা মৃদুভাসী কোমল স্বভাবের এবং ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। এখানে আমার মনে একটা খটকা ছিল একটা শুভ কাজে মাত্র তিনজন যাব চতুর্থ জনকে পাবো না? আমার বন্ধু জানে সে আর জয়ন্তদা যাবে । কোনভাবেই অংক তিন থেকে চার করতে পারলাম না ভগবানকে ডেকে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকাল সকাল উঠলাম। স্ত্রীকে যতটা সম্ভব সাহায্য করে দিলাম রান্না করার কাজে। আমারও ছোট্ট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আগে থেকেই একটা তালিকা তৈরি করেছিলাম কি কি জিনিসপত্র নিয়ে যেতে হবে। যেমন পূজা উপকরণ ,খাদ্যদ্রব্য আর পথে চলার সামগ্রী।
শরীর শুদ্ধ করার জন্য সাবান ও শ্যাম্পু সহযোগে স্নান টা সেরে ফেললাম। স্নান করার সময় ডান চোখে অধিক মাত্রায় শ্যাম্পু অথবা সাবান যাওয়ার ফলে খচখচ করতে শুরু করল। ঈশ্বর বন্দনা করার পর সামান্য আলু সেদ্ধ এবংঘি সহযোগে ভাত ডাল খেয়ে নিলাম।
এই অভিযানে সবাই নতুন পোশাক পরে। আমিও একটা নতুন সাদা গেঞ্জি ও সাদা প্যান্ট কিনেছিলাম। যদি ও অধিকাংশ লোক গেরুয়া রং এর পোশাক পরে গঙ্গাজল নিয়ে যেতে পছন্দ করে। আর সবার সঙ্গে থাকে গামছা। নতুন গামছার ভীষণ রং ওঠে এই কারণে আমি গামছা বর্জন করে একটি তোয়ালে কিনেছিলাম।নতুন পোশাক পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, ইষ্ট দেবতাকে প্রণাম করে, স্ত্রী ও মাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে রওনা দেব ইতিমধ্যে মা আমাকে পিছনে ডাকলেন এবং ১০০ টাকার একটি নোট আমাকে দিলেন।
১২ ই আগস্ট ২০২৩ সকাল ১০: ২৭ মিনিট। শনিবার।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আমার বাম নাকে নিশ্বাস চলছে সেই কারণেই আমি বাঁ-পা প্রথমে গেটের বাইরে ফেলে যাত্রা শুরু করলাম।
## স্বরোদয় শাস্ত্র অনুযায়ী কোন যাত্রা করার আগে যে নাকে নিঃশ্বাস চলে প্রত্যেক ব্যক্তি সেই দিকের পা আগে ফেলে যাত্রা করা উচিত তাহলে যাত্রার নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় ।
আমি স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে বকুলতলায় অপেক্ষা করছি আমার বন্ধুর জন্য। মাথার মধ্যেই একটাই অংক ঘুরছে কিভাবে তিন থেকে চার হবে। হঠাৎ করে চোখের অসুবিধাটা যেন একটু বেড়ে গেল ডান চোখটাই কেমন জানি একটু আবছা আবছা দেখছি ,দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। চোখটা কটকট ও করছে । তাই কখনও চোখ বন্ধ করে,কখনো চোখ খুলে বসে আছি।
এই সময় একজনকে দেখছি জলযাত্রীর পোশাকে আসছে । হ্যাঁ আমি তাকে চিনি বিপ্লবদা কিন্তু চোখটা অতিরিক্ত পরিমাণে কট কট করায় চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম তার সঙ্গে কোন রকম কথা বলিনি সে আমাকে টপকে চলে যায়।
আমি অধীর আগ্রহে বসে আছি কখন জয়ন্তদা ও কৌশিক ব্যানার্জি আসবে। এগারোটা বেজে বারো মিনিটে বারুইপাড়া লোকাল জনাই রোড স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে। যত সময় যায় তত ই মনের উপর চাপ পড়ে যে তারা কখন আসবে।
দশটা বেজে ৫৫ মিনিট হয়ে গেছে তাদের দেখা নেই। মনে মনে ঠিক করছি তাদের যদি না পাই তাহলে পুরো অভিযান টা আমি একাই যাবো। (এইসব ভাবনাগুলো ভাবা সহজ কিন্তু করে দেখানোটা খুবই শক্ত।) কি করবো মনকে ঠান্ডা রাখতে জয়ন্ত দা কে ফোন করে বসলাম। কৌশলে জয়ন্ত দার অবস্থান জানতে পারলাম আর মন ও ঠান্ডা হলো।
এগারোটা বেজে দু মিনিটে দুজনকে দেখছি আস্তে আস্তে স্টেশনে আসছে। আমরা যখনই হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই স্টেশনের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসি। সেই কারণেই তারা আমাকে অতিক্রান্ত করে চলে যাচ্ছে। স্টেশনের গোড়াতেই বকুলতলা।
আমি খুব আস্তে জয়ন্তদা কে ডাকলাম, জয়ন্তদা……
আমার বন্ধু আমাকে দেখে আশ্চর্য হল এবং তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন যেন আমাকে ভূত দেখার মত ভূত দেখছে।তার চোখের মনি গুলো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল।বুঝতে পারছিলাম তারা দুজনেই খুবই আনন্দিতহয়েছিল।আমরাতিনজনেই সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। আমি জানতাম না আমাদের টিমে বিপ্লবদা অন্তর্ভুক্ত হবে। তখন ও আমার চোখটা ভীষণ কটকট করছে, চুপচাপ ছিলাম।
ট্রেন যথাসময়ে চলে এলো এবং আমরা বালি পৌঁছে গেলাম।
বালি স্টেশনে নেবেই আমার মোবাইলেই আমাদের সকলের ছবি বন্দি করে ফেললাম।
টিকিট শেওড়াফুলি পর্যন্ত কাটা ছিল। মেন লাইনের ব্যান্ডেল লোকাল ধরে আমরা শেওড়াফুলি পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। শেওড়াফুলি নাবার পর চোখের সমস্যাটা বেশ খানিকটা কমলো।
শেওড়াফুলির একজন ফেরিওয়ালা, স্টেশনে নামতেই,
দাদা বাঁক নেবে পাঁচ টাকা……….
আমার মনে অনেক প্রশ্ন
আজকে যা পরিস্থিতি একটা লোক যদি একটা বাঁক ৫ টাকায় বিক্রি করে সে কত টাকা লাভ করবে এবং কিভাবে সে সংসার চালাবে।
চারজনের একটা ছোট্ট সংসার সুষ্ঠু হবে চালাতে কমপক্ষে মাসে ১৫০০০ টাকা দিনে ৫০০ টাকা প্রয়োজন হয়।
স্টেশন থেকে আমরা বেরিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। পথে প্রচুর জল যাত্রীদের প্রয়োজনীয় উপকরণের দোকান। দেখতে বেশ ভালই লাগছিল।
আমার বন্ধু কৌশিক ব্যানার্জি ওরফে বান্টি
তার নির্দিষ্ট দোকান থেকে বাঁক, ঘন্টা, দড়ি প্লাস্টিকের ঘটি কেনাকাটি করল। জয়ন্ত দা ও নির্দিষ্ট দোকান থেকেই সাজিয়ে নিল বাঁক ও ঘট।
বিপ্লবদা বাড়ি থেকেই বাঁক নিয়ে এসেছিল ঘটি ওখান থেকে কিনে নেয়। আমি দুটো মিলটনের কোম্পানির বোতল কিনে নিয়েছিলাম আগে থেকেই। বোতলের গলায় দড়ি বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের সবার কেনাকাটি শেষ।
ওখানে অনেক গুলোই ঘাট আছে। প্রত্যেকটা ঘাটেই বাঁক রাখার ব্যবস্থা করা থাকে। সেখানে এক মাসীর দায়িত্বে বাঁক জমা করে গঙ্গার ঘাটে এগিয়ে গেলাম।
বাতাসে আপেক্ষিক আদ্রতার কারণে সেদিন ছিল ভীষণ গরম। গঙ্গার ঘাটে বসে আমরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়া টা সেরে নিলাম। রোদ্দুরের তাপ বেশি থাকার কারণে আমরা একটু বেশি সময় বিশ্রাম করে নিলাম।
গঙ্গায় ডুব দিয়ে জল তোলার পর আমাদের যাত্রা শুরু হল বিকাল তিনটে বেজে ২৭ মিনিটে।
দিনটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য আবার ছবি তোলা হল।
ওম নমঃ শিবায়। বলে তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। প্রত্যেকের জলযাত্রীর মধ্যেই অফুরন্ত উদ্যম ছিল।
আমার খালি পায়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার কোন অভিজ্ঞতা নেই। এখানে বিপ্লব দার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। ছোট ছোট পাথরের কণা গুলো পায়ের তলায় ফুটছিল। বিপ্লবদা আমাকে সহযোগিতা করলো, শুধু সামনের দিকে দেখলে হবে না ,পা কোথায় পড়ছে সেটা দেখে ফেলতে হবে। তাহলে কষ্ট কম হবে। যেমন কথা তেমন কাজ,বেশ আরামও পেলাম। তখনো রৌদ্র ছিল ,রাস্তাটা একটু গরম। রাস্তার পাশে বিল্ডিং গুলোর ছাওয়া পড়েছিল, আমি চেষ্টা করছিলাম যতখানি ছাওয়া দিয়ে যাওয়া যায়।আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন মহিলাদের সংখ্যা প্রচুর ছিল এবং তারা আমাদের চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল তাদের ভালো অভিজ্ঞতা আছে। পুরুষের ও সংখ্যা কম ছিল না।কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম বেশি কথা বলা যাবে না গলা শুকিয়ে যায়। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকা আর হেঁটে চলা।শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বরের মন্দির প্রায় 40 কিলোমিটার। প্রথম ১০ কিলোমিটার কোন অসুবিধা হয়নি খুব সহজেই পাশ করে দিয়েছি।সম্পূর্ণ রাস্তাটা গাড়ি চালানোর জন্য খুবই সুন্দর কোথাও কোন খানাখন্দ ছিল না । কিন্তু খালি পায়ে এই পিচ রাস্তা উপরে হাঁটা বেশ কষ্টকর। কষ্ট লাঘব করার জন্য আমি রাস্তার ধারে যে সাদা রং করা থাকে তার উপর দিয়ে হাঁটছিলাম তবু কিছুটা কষ্ট কম হচ্ছিল যেহেতু রং এর অংশটা মসৃণ ছিল।দশকিলোমিটার হাঁটার পর মনে হচ্ছিল এই ছোট ছোট পাথর কনা গুলো যেন পায়ের তলার চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।বিপ্লবদা প্রথমেই আমাকে বলেছিল anklate টা যাত্রা শুরু থেকেই পড়ে নাও কিন্তু আমি শুনিনি ।১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর মনে হয়েছে সে ঠিক কথাই বলেছিল। পায়ের নিরাপত্তার কারণে পায়ে anklate পরতে বাধ্য হলাম ।প্রথম দশ কিলোমিটার আমাদের মধ্যে সেরকম বিশেষ কোনো ব্যবধান ছিল না। কখনো আমি আগে কখনো বিপ্লবদা আগে বা কখনো আমার বন্ধু আর বিপ্লবদা আগে জয়ন্তদা সব সময় মাঝামাঝি পজিশনে ছিলেন। এক সময় আমি অনেকটাই আগে এগিয়ে যাই জয়ন্তদা আমাকে ফোন করে বলে তুমি একটু বিশ্রাম নাও আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছাচ্ছি তোমার কাছে। এই সুযোগে আমি একটা জায়গায় বসে বেশ কিছুক্ষণ মোবাইল ঘেঁটে নিলাম। সময়টা দশ মিনিটের বেশি ছিল না। মোবাইলে আমার লোকেশন দেখলাম, কত কিলোমিটার দূরে মালিয়াপার্ক দেখে নিলাম ।কতক্ষণ সময় লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটা কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি, ২ কিলোমিটার হাটার পরেই জল যাত্রীদের সেবা করার জন্য বহু প্রতিষ্ঠান বহু অস্থায়ীসেবা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। সেইসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে জল যাত্রীদের পানীয় জল, বিস্কুট, চা, দুধ ,জিলিপি, সিঙ্গারা,বাতাসা, মিষ্টি, শসা ছোলা ভেজানো, বাদাম ভেজানো,লুচি,,তরকারি ,ভাত ,ডাল , খিচুড়ি ,শরবত ,লজেন্স, লস্যি, পায়েস ইত্যাদি ইত্যাদ রকম খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন করেছিল। শুধু খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে ক্ষান্ত হয়নি ।এই সেবা ক্যাম্পে ছিল প্রাথমিক চিকিৎসার সুবর্ণ সুযোগ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দেখেছি জল যাত্রীদের পা ধুয়ে পরিষ্কার করে তাদের পা মেসেজ করে দেওয়া।পরিষেবা দেখে মনটা ভরে গিয়েছিল যতটা ঠিক ততটাই মর্মাহত হয়েছিলাম জল যাত্রীদের অভব্য অসভ্য আচরণ দেখে।
আমি অনেক জল যাত্রীকে দেখেছি যারা জলের বোতল সংগ্রহ করেছে এবং জলটা নষ্ট করেছে। না খেয়ে ফেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি বিপরীত ছবি দেখেছি অনেক জল যাত্রী সমস্ত খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে তা ব্যাগে রেখেছে বাড়ি নিয়ে যাবে এবং সেটা পরে ব্যবহার করবে। আমি বিভিন্ন সেবা সমিতি থেকে ছয় থেকে সাত বোতল জল সংগ্রহ করেছিলাম এবং পুরো জল টাই আমার যাত্রাপথে লেগেছে। জল ছাড়া আমি কোন সেবা সমিতি থেকে কোনরকম সাহায্য গ্রহণ করিনি।
সম্পূর্ণ রাস্তার 80% স্ট্রিট লাইটলাইট ছিল। প্রায় সমস্ত সেবা ক্যাম্পেই চলছিল উচ্চ ডেসিবেলে দেবাদিদেব মহাদেবের ভক্তিগীতি।
পুলিশ প্রশাসনেরও সহযোগিতা কম ছিল না। সমস্ত রাস্তাতেই আমি প্রচুর পরিমাণে পুলিশ প্রশাসনকে কর্তব্যরত অবস্থায় দেখেছি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে,সমস্ত লাইট জ্বলছে, মহাদেবের গান চলছে, পাশাপাশি জল যাত্রীদের হর হর মহাদেবের স্লোগান। বোল বোম তারক বোম ::ধ্বনি কানের ভিতর ঢুকছে পায়ে ব্যথাও শুরু হয়ে গেছে, এক অদ্ভুত পরিবেশ। মাথায় একটাই চাপ আমাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
মুখ তুলে দেখি সামনে জয়ন্তদা দাঁড়িয়ে, চলো রাজা আমি এসে গেছি। বেশ বুঝতে পারছি পায়ের ব্যথাটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। চলার গতিও কমছে, তবু চলছি , পায়ের মার্সেল গুলো টনটন করছে। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর মনে হচ্ছে যেন আগের মতো আর হাঁটতে পারছি না।
সমস্যা এখান থেকেই শুরু।
আরো ৫ কিলোমিটার হাটার পর পায়ের ব্যথা আরো বাড়লো। আমি আর সবার আগে নেই ,সবার পিছনে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে রাস্তাটা ভিজে গেছে। পায়ের পাতায় জল লেগে পায়ের চামড়া নরম হয়ে গেছে বুঝতে পারছি পাথরের টুকরাগুলো যেন আরো খুব সহজেই আমাকে ব্যথা দিচ্ছে। আমাদের টিমের সবার সঙ্গে সবার দূরত্বের ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যথাকে উপেক্ষা করে হাঁটা চালু রেখেছি, গতি ক্রমশ মন্থর হয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর জয়ন্ত দার ফোন তুমি কোথায়? আমি উত্তর দিলাম আমি বেশ পিছনে আছি। ও প্রান্ত থেকে জয়ন্তদা বলছে আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরে জয়ন্ত দার কাছে পৌঁছালাম দেখলাম বান্টি এবং বিপ্লবদা তাও দাঁড়িয়ে আছে ।কাছে পৌছালাম। বললাম একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। অল্প কিছুক্ষণ হাটার পর রাস্তার পাশে একটা শিবলিঙ্গ দেখতে পেলাম। ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে আট মিনিট। শ্বেত পাথরের বেদীর ওপর শিবলিঙ্গ টা বসানো আছে। সেখানে আমরা সবাই একটু বিশ্রামও করলাম। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালার পর আবার যাত্রা শুরু।
ভাবছি আর হাঁটছি ব্যাথা আর ব্যাথা। কি করে সম্পূর্ণ করবো আমার এই অভিযান। ব্যথার পরিমাণটা আগের চেয়ে আরেকটু বৃদ্ধি পেয়েছে। গতি আরেকটু মন্থর হয়েছে। সবাই অনেকটাই এগিয়ে গেছে আমি সবার পিছনে। আগে একটা ছন্দে হাঁটছিলাম। হাঁটার ছন্দ মাথায় উঠেছে। দেখতে পাচ্ছি আমাকে সমস্ত জল যাত্রী পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন আমি কি সম্পন্ন করতে পারব এই অভিযান?
গভীরভাবে অন্য জল যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, সবার মধ্যেই কিছুটা ক্লান্তি ভাব এসেছে কারণ বিকাল চারটের মত কারো মধ্যে সেরকম আর অতটা গতি নেই। প্রত্যেকের মধ্যেই কিছুটা হলেও গতি মন্থর হয়েছে।
তখন রাত সাড়ে নটা। জয়ন্ত দার আবার ফোন,আমরা কাশি বিশ্বনাথ সেবা প্রতিষ্ঠানে আছি। কাশী বিশ্বনাথ প্রতিষ্ঠান রাস্তার বা দিকে ,তুমি চলে এসো। আমার একটু কষ্ট হচ্ছে আসতে একটু সময় লাগবে। ৩০ মিনিট হাঁটার পর রাত দশটায় কাশী বিশ্ব নাথ সেবা প্রতিষ্ঠানে পৌছালাম।
এবার একটা বড় বিশ্রামের প্রয়োজন শরীর আর চলছিল না এই সেবা প্রতিষ্ঠানটি মালিয়ায় অবস্থিত। শেওড়াফুলি থেকে মালিয়া দূরত্ব কুড়ি কিলোমিটার। আমাদের এই অভিযানের অর্ধেক রাস্তা অতিক্রান্ত করেছি। ওম নমঃ শিবায়।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর বাড়িতে একটা খবর দিলাম। ভিডিও কল করে বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বললাম। রাতের খাওয়া দাওয়া টা এখানেই সেরে নিলাম। খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার জন্য কল খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। আমার কি ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে, কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না ,ভাষায় প্রকাশ করা এক প্রকার অসম্ভব। তার ওপরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশজোড়েই। আর তার সঙ্গে হিমেল হাওয়া। আমার ঠান্ডা লাগছিল। এখানে অনেকেই ঘুমাচ্ছিল। আমারও খুব শুয়ে পরতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু জায়গা ছিল না। খবরের কাগজ পেতে একটু শোয়ার জায়গা করে নিয়েছিলাম কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলাম কিন্তু শুয়ে আশ মেটেনি। বাকি তিনজন বসেছিল আমি শুয়ে পড়েছিলাম।
রাত বারোটা পনের। অভিযান সম্পূর্ণ করতে হবে। দেরি করলে দেরি হয়ে যাবে। বৃষ্টির মধ্যেই আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ওই সময় বেরোনোর আমার একটু ও ইচ্ছে ছিল না। একে বৃষ্টি তারপরে অতিরিক্ত ক্লান্ত এবং পায়ে ভীষণ ব্যথা। উভয় সংকট নিয়েই আবার বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই বেশ বুঝতে পারছি আর মনে হয় আমি হাঁটতে পারবো না। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমার পায়ের ব্যথা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হেঁটে চলার শেষ শক্তি টুকু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটু হাঁটার পরে দেখি জয়ন্তদা অপেক্ষা করছে। জয়ন্ত দাকে আমি বললাম জয়ন্তদা আমি আর হাঁটতে পারছি না। জয়ন্তদা আমাকে বলে তুমি যদি একান্তই না হাঁটতে পারো তাহলে গাড়ি করে লোকনাথে চলে যেও ওখানে অপেক্ষা কর আমাদের সঙ্গে দেখা হবে। এই বলে জয়ন্ত দার প্রস্থান। আমিও সামান্য এগিয়ে একটি সেবা সমিতির চেয়ারে বসে পড়লাম। মাথার মধ্যে একটাইচিন্তা কিভাবে এই অভিযান সম্পূর্ণ করব।
রাস্তার ধারে কত ভ্যান টোটো ওয়ালা আমার অবস্থা দেখে আমার কানের কাছে এসে বলছে দাদা লোকনাথ পৌঁছে দেবো, তারকেশ্বর পৌঁছে দেব যাবেন? আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিইনি। কিন্তু মনে মনে অসম্ভব লোভ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেতে পারলে বেঁচে যাই।
রাজার আত্মা রাজাকে প্রশ্ন করলো, তুমি কি মানুষ ? তোমার কি বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
আমার কাছে কোন সুউত্তর ছিল না।
রাজার আত্মাকে মহাদেব বললেন :চেয়ে দেখো উত্তর তোমার পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেটা তোমার পছন্দ সেটাই তুমি করবে।
এতো ব্যাথা নিয়ে আমার পক্ষে হাটা আর সম্ভব নয়। আমার চেয়ে অনেক কম বয়সী ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দিব্যি হেটে যাচ্ছে আমি কেন পারব না ।আমার তো কোন শারীরিক অসুস্থতা নেই। আমার বন্ধুর পেটের অনেক সমস্যা তাই নিয়ে সে তো আমার আগে এগিয়ে চলেছে। জয়ন্তদা আমার চেয়ে অনেক বয়স জ্যেষ্ঠ সে যদি পারে আমি কেন পারব না। বিপ্লব দা আমার চেয়ে বয়সে বড় শারীরিকভাবে সুস্থ সে তো দিব্যি এগিয়ে চলেছে। মানছি সবার শারীরিক সক্ষমতা এক রকম নয়। এক বয়স্ক মহিলাকে দেখেছি তার বারো বছরের কন্যাকে পিঠের করে নিয়ে যাচ্ছে ।দেখে, মনে আমি অনেক পজিটিভ এনার্জি পেয়েছি। এক বাবাকেও দেখেছি তার দশ বছরের পুত্রকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে পুত্রের আর হাঁটার ক্ষমতা নেই। চার বছরের শিশু পুত্র বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা তাকেই কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছে। মহেশ্বর এত পজিটিভ এনার্জি আমার চোখে দেখিয়ে দিচ্ছে আমি যদি শিক্ষা গ্রহণ না করতে পারি তাহলে দোষ তো আমার।
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমাকে যুদ্ধ জয় করতেই হবে। কিন্তু তার জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
অংকটা কি করে মেলাবো বুঝতেই পারছি না দুই আর দুই চার করতে হবে কিন্তু আমি তো আটকে যাচ্ছি। মনে মনে ঠিক করলাম একদিন লাগুক দুইদিন লাগুক আমি এই অভিযান শেষ করব সময়টাকে বাড়িয়ে নিলাম মনের ওপর থেকে চাপ অনেকটাই কমে গেল ।সেবা সমিতি আছে কোন অসুবিধা হবে না অভিযান আমি সম্পূর্ণ করবই। আমার সাথীরা এগিয়ে গেছে কোন অসুবিধা নেই ।আমিও জয়লাভ করব । কিছুটা দেরি হবে, কোন অসুবিধা নেই । বলতে পারব আমি অভিযান সম্পূর্ণ করেছি ,গাড়ি চাপতে হয়নি।
কানের কাছে তারস্বরে মহাদেবের সংগীত চলছিল তাই জন্য এখানে বেশিক্ষণ আর বসতে পারলাম না। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম ।বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে মাথার উপরে প্লাস্টিক দিয়ে হাঁটছি। একে তো পায়ে কষ্ট আর বৃষ্টির জল যদি আমার মাথায় লাগে তাহলে মাথার যন্ত্রণা শুরু হবে কষ্টের মাত্রা আরো বাড়বে।
এখন রাত দুটো। কোন এক সেবা সমিতি ঘোষণা করছে এখান থেকে তারকেশ্বর এখনো ১১ কিলোমিটার। আমি যতক্ষণ পারছি হাঁটছি তারপরেই বেশিক্ষণ বিশ্রাম করছি। আর নিজের দিকে খেয়াল রাখলাম পায়ে যেন কোন ক্ষত না হয়ে যায়। সেই জন্য বিশ্রামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলাম। নিজের ইচ্ছামত চলতে লাগলাম। কখনো কখনো ব্যথা একটু কমে গিয়েছিল বা অসার হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারিনি । ব্যথাটা কখনো ট্রান্সফার হচ্ছিল বাঁ পায়ে থেকে ডান পায়ে আবার ডান পা থেকে বাঁ পা। এখন আবার নতুন ব্যথার উৎপত্তি হল দুই কুঁচকিতেঅল্প অল্প ব্যথা অনুভব করছি। আগে যেরকম চিন্তা হচ্ছিল কি করে পারব এখন আর কোন চিন্তাই নেই। কুচকিতে ব্যথা হচ্ছে হোক না কি আছে? আমি তো দু-তিন দিন টার্গেট নিয়ে নিয়েছি। আর তো মাত্র ১০ কিলোমিটার আছে। কোন সমস্যা নেই। অল্প অল্প হাঁটা বেশি বেশি বিশ্রাম। পরিকল্পনাটা করার পর দেখছি মানসিকভাবে আমি শক্তিশালী হয়ে উঠেছি। আমাকে বহু জলযাত্রীর ওভারটেক করে এগিয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে কোনো ক্ষোভ ,অভিমান,দুঃখ ,কষ্ট, ক্রোধ, কিচ্ছু নেই। সমস্ত নেগেটিভ এনার্জিকে গ্রাস করার ক্ষমতার জন্ম হয়েছে। আমি যেন এক ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়েছি। যেকোন সমস্যার সম্মুখীন করতে আমি প্রস্তুত। আমি বুঝতে পারছি আমাকে কোন শক্তি আটকাতে পারবে না। সবকিছু গ্রাস করার ক্ষমতা আমার আছে। জানিনা কিভাবে এত মানসিক শক্তি পেয়ে গেলাম।
এখন ভোর চারটে। কত কিলোমিটার বাকি মোবাইলে দেখার আর কোন ইচ্ছা নেই। কোন জলযাত্রীর মধ্যে আর উচ্ছৃঙ্খলতা ,উদ্দীপনা, কিছুই নেই, মুখে কোন বাক্য নেই নিঃশব্দে চুপচাপ সবাই মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিকাল চারটে যখন রওনা দিয়েছিলাম তখন এক দৃশ্য ,এখন ভোর চারটে সম্পূর্ণ এক আলাদা দৃশ্য যেন সবাই ভগবানের অনুগত শিষ্য।
আমার মোবাইলে পাঁচটার এলার্ম দেওয়া থাকে। ভোর পাঁচটা। আমার গতি মন্থর থেকে মন্থরতর হয়ে গেছে। সামনে একটা বড় গেট দেখতে পাচ্ছি তাতে রঙিন আলো দিয়ে সাজানো।
ইংরেজিতে লেখা আছে ওয়েলকাম টু তারকেশ্বর। কি আনন্দ ! আমি টার্গেটের কাছাকাছি। শুধু আমার গতি মন্থর থেকে মন্থরতর হয়নি, দেখছি সকলের গতিক্রমশই কমে আসছে। জলযাত্রীর সংখ্যা বেশ কম, নিস্তব্ধ ,খালি টুংটাং আওয়াজ বাঁকের।
ভোরের কাকের ও অন্যান্য পাখির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। রাস্তার দুপাশে বাঁশ গাছ। স্ট্রিটলাইটগুলো তখনও জ্বলছে। একটি ছোট্ট মেয়ে সাত বছর বয়স হবে জামার খোট চিবাতে চিবাতে মায়ের হাত ধরে এগিয়ে চলছে। তার মায়ের হাঁটার গতি তার ছোট মেয়ের চেয়েও কম ,মেয়েই যেন মাকে টেনে নিয়ে চলেছে। যেসব মহিলারা সারা রাস্তা হেঁটে হেঁটে এসেছেন তাদের দেখে মনে হল তারা কেন উচ্চবিত্ত পরিবারের নয় তারা সবাই খেটে খাওয়া মানুষের দল। আমার একটি কবিতার কথা মনে পড়ে যায় ক্লাস ইলেভেনে পড়েছি। ওরা কাজ করে ।
ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায়।
আজ রবিবার। ভোর পাঁচটা কুড়ি মিনিট। জয়ন্ত দার ফোন। রাজা তুমি কোথায়? আমি কিছুক্ষণ আগে ওয়েলকাম টু তারকেশ্বর পার করেছি। ওপার থেকে জয়ন্ত তার উত্তর এখনো অনেকটা সময় লাগবে লোকনাথ মন্দির এসে পৌঁছাতে আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
আরো চার কিলোমিটার হাটার পর লোকনাথ মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। মেন রাস্তা ছেড়ে লোকনাথ মন্দিরের গলিপথে জয়ন্তদা এবং আমার বন্ধু বান্টির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুজনেই বিধ্বস্ত অবসন্ন এবং ভীষণ ক্লান্ত দেখতেই বুঝতে পারলাম। তারাই এগিয়ে যেতে চাইলো আমি আর আটকাইনি। বিপ্লবদার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
আমি মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। আমি ভেবেছিলাম হয়তো এখানে কোন লোকনাথ ঠাকুরের মূর্তি থাকবে। কিন্তু তা নয় এখানে এক শিবলিঙ্গ মাটির তলায় আছে। তার মাথাতেই জল ঢেলেআছে।ছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি। জলের ওপরেই জল ঢেলেছি। মন্দিরে ঢোকার আগে লাইন দিতে হয়েছিল। মন্দিরের ভিতরে সেবাইতরা সমস্ত দর্শনার্থীদের পা ধুয়ে দিচ্ছিল। মন্দিরটি ছোট একটি নাট মন্দিরের মতো। ঘাড় ধরে ঢুকিয়েছে আর ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছে। কাউকেই দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই ভাবেই যদি না ঢোকায় এবং না বার করে তাহলে এক চরম বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। কারণ ভক্তের তো অভাব নেই সারাদিন ভক্ত আসতেই থাকে।
মন্দির থেকে বেরিয়েই দেখি কিছু ভিক্ষুক বসে তারা কিছু অর্থ সাহায্য চাইছে। সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করে আমি আবার এগিয়ে চললাম। না এবার একটা বড় বিশ্রামের প্রয়োজন। ৬:৩০ মিনিটে আমার এখানের পুজো সমাপ্ত হয়েছে। এখানের একটি বিশ্রামাগারে আমি এক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম।
সাড়ে সাতটায় আবার যাত্রা শুরু করলাম। আমার ক্লান্তি ভাবটা বেশ কিছুটা কমেছে। মোবাইলে দেখলাম প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে তারকেশ্বর মন্দির। অংকের হিসেবে এবং আমার শরীরের পরিস্থিতি যা এক ঘণ্টার আগে পৌঁছাতে পারবো না। এই সময় একটা ফোন এসেছিল বিপ্লবদার সে বাড়ি চলে যেতে চাইছিল কারণ তার সবকাজ হয়ে গেছে, আমি আর আটকাইনি বললাম তুমি চলে যাও। এই আড়াই কিলোমিটার যেতে তিনবার বিশ্রাম নিয়েছি। মেন রাস্তা ছেড়ে যখন তারকেশ্বরের মন্দিরের গলিপথে ঢুকছি, মনে মনে আন্দাজ করেছি মন্দির হয়তো আর 200 মিটার দূরে, ২০০ মিটার যাবার পর পা আর চলে না। আর কোন বিশ্রাম নেওয়ারও জায়গা নেই। রাস্তায় পথ নির্দেশ করা আছে এবার তস্য গতিতে ঢুকতে হবে। ঠিক এই সময় আবার জয়ন্তদা এবং আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাদের জল ঢালা হয়ে গেছে। হাসিমুখে তাদেরও বিদায় জানালাম। আমি মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। একটি ৩০ বছরের ছেলে ওই গলিতে সাইকেল চালাচ্ছিল সে আমার পায়ের পাতার পাঁচটা আঙুল এর উপরেই সাইকেলের প্রথম চাকাটি চাপিয়ে দিল। ওই পাঁচটা আঙ্গুল থেকেই যেন আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। এত ব্যথা পাওয়ার পরেও কেন জানি না তাকে আমি একটা কোন কথাও বলিনি আমার ক্রোধ যেন কোথায় উড়ে চলে গেছে আমি নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এই পরিবর্তন কিন্তু আমি কোনদিন আমার মধ্যে দেখতে পাইনি।
আমি মনে মনে একটা কাল্পনিক তারকেশ্বর মন্দির তৈরি করেছিলাম দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো ,মন্দিরটা প্রায় এরকমই হবে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ আমি দেখেছি। ছোট্ট লোকনাথ মন্দিরের মতো নাট মন্দির। রাস্তা উঁচু হতে হতে মন্দিরকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে ৫ ফুট। ভেবেছিলাম তারকনাথের দর্শন পাব। হয়নি। শুধু জল ঢেলেই ক্ষান্ত হয়েছি।
ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায়।
মন্দির চত্বর থেকে বেরোনোর আগে একজন সাধবা মহিলা সাদা শাড়ি লাল পাড় পরিহিতা আমাকে ভক্তি সহকারে নিজের ছেলের মতো আশীর্বাদ করলেন স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখে সংসার করো। তাকে অর্থ সহ্য করার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসি।
আমার অভিযান সম্পূর্ণ হয়েছে সবই ঈশ্বরের আশীর্বাদ।। এখন সময় সকাল ন'টা।।
ভেবেছিলাম তিনজনেএকসঙ্গে বাড়ি ফিরব ,তারা আমার জন্য তারকেশ্বর স্টেশনে অপেক্ষা করবে। আমার কাছে ভেজানোছলা বাদাম কাজু কিসমিস ছিল, বাড়ি থেকে এনেছিলাম। ট্রেনে বসে বসে একসঙ্গে খাব।
আস্তে আস্তে হেঁটে মেন রাস্তায় এলাম একটা দোকানের চাতালে বসে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছি। এমন সময় জয়ন্ত দার ফোন, তোমার বন্ধুর পটির খুব সমস্যা হচ্ছে। সে আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। বন্ধু আমাকে বলে তুই একটা টিকিট কেটে বাড়ি চলে আসবি। এখানে সিগন্যালটা খুব কম ছিল আর কোন কথা হয়নি ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছিলাম না।
আমার মধ্যে তখনো মানসিক শক্তি অবশিষ্ট ছিল সমস্ত রকম অসুবিধা মোকাবিলার করার জন্য তৈরি ছিলাম। মহাদেব যেন আমাকে কানে কানে বললেন তোমার অভিযান এখনো শেষ হয়নি, বাড়ি পৌছালে তবেই তোমার অভিযান সম্পূর্ণ হবে। বুঝতে পারছি ঈশ্বর চাইছেন না যে আমি তাদের সঙ্গ লাভ করি।
যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার এগিয়েছিলাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম টোটো পাওয়া যাবে স্টেশন যাওয়ার জন্য, সে বলল আপনি ভুল পথে এসেছেন স্টেশন ওই দিকে।
ছেলেটি আমাকে বলেছিল টোটোর প্রয়োজন নেই আপনি হেঁটে চলে যান স্টেশন সামনেই।
আমার পরিস্থিতি অনুযায়ী স্টেশনটা আমার কাছে অনেক দূর মনে হয়েছিল। যাইহোক দশটা নাগাত স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। টিকিট কেটে স্টেশনে বসতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। এক মিনিটে কি গভীর ঘুম। স্টেশনে ঘোষণা হচ্ছে ১০ঃ২৮ মিনিটে তারকেশ্বর হাওড়া লোকালএক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে। স্টেশন ময়, জলযাত্রীর ছয়লাপ। আমি দেখতে পাচ্ছি ট্রেন ঢুকছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। সবাই উঠে যাওয়ার পর আমি দরজার ধারে উঠে দাঁড়ালাম। ট্রেনের ভিতরে শুধু জলযাত্রীর ভিড় কোন সাধারণ যাত্রী নেই। ট্রেন সময় মত ছেড়ে দিল। মিনিট ৩০ এর মধ্যেই আমি কামারকুন্ডু স্টেশন পৌঁছে গেলাম। নেবেই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম, ওখানে আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেল। স্টেশন টা অনেক উপরে অনেক দূর পর্যন্ত আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ।সবে মাঠে ধান গাছ পোতা হয়েছে। হালকা রোদ্দুরে পায়ের ব্যাথা গুলো বেশ আরাম বোধ করছিলাম।পা থেকে anklate আমি খুলে ফেললাম। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর কিছুটা জল খেয়ে আস্তে আস্তে নিচের প্ল্যাটফর্মে এলাম। খুব সাবধানে রেললাইন পার করে ওভার ব্রিজ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এলাম। ৫ মিনিটের মধ্যেই বর্ধমান হাওড়া লোকাল এলো। একদম শেষের কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লাম। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই জানাই রোড পৌছালাম। ১১ঃ৪৫ এ বাড়ি ।
ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায় ওম নমঃ শিবায়।
আজ ১৫ ই আগস্ট লেখাটা সম্পূর্ণ করলাম।
15/08/2023.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন